ঘুষবাণিজ্য,ফাইল আটকে রেখে বছরের পর বছর ঘুরানো,হয়রানিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ থাকার পরও গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) কার্যালয়ের কানুনগো মো:জাহাঙ্গীর আলম নান্নুর বিরুদ্ধে। তার হাতে জিম্মি শিল্প-কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি ক্রয়ের পূর্ব অনুমোদন, সীমানা নির্ধারণ, সরকারি জমির লিজ ও নবায়নের জন্য আসা সেবা প্রার্থীরা।
ভুক্তভোগেীদের অভিযোগ ‘কাজপত্র ঠিক থাকলেও নান্নুর দাবি বিঘা প্রতি তাকে দিতে হবে লাখ টাকা।’ সাবেক চিফ হুইপ পটুয়াখালী-২ আসনের সংসদ সদস্য আ স ম ফিরোজের আত্মীয় পরিচয়ে কাউকে পাত্তা দিতেন না নান্নু। তার দাপটের কাছে অসহায় ছিলেন জেলার অন্য কর্মচারীরাও। ঘুষের টাকায় তিনি নিজ এলাকা পটুয়াখালীর বাউফল ও ঢাকায় গড়েছেন বিপুল সম্পদ।
৫ আগস্ট স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পতন হলে অন্য সরকারি কর্মচারীদের তোপের মুখে পড়েন নান্নু। ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসকের কাছে ধরে নেয়া হলে স্বেচ্ছায় বদলি হয়ে চলে যেতে ৭ দিনের সময় চেয়ে ওই সময় রক্ষা পেলেও এখনো তিনি রয়েছেন বহাল। এ নিয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে সরকারি কর্মচারী ও ভুক্তভোগীদের মধ্যে।
জানা গেছে,‘সরকারি সিদ্ধান্তে জেলা প্রশাসকের অনুমোদন ছাড়া শিল্প, বাণিজ্যিক ও আবাসিকের জন্য ক্রয় করা জমি রেজিস্ট্রি করা যাবে না’ উল্লেখ করে ২০২২ সালের ২০ জুলাই জেলার সব সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে চিঠি দেয় তৎকালীন জেলা প্রশাসন। তা ছাড়া প্রতিষ্ঠানের নামে আগের কেনা জমির ‘নামজারি জমাভাগ’,সরকারি খাস বা বনের জমির সাথে ব্যক্তির জমি থাকলে খাজনা প্রদানে নামজারি জমাভাগ, সীমানা নির্ধারণ, অর্পিত সম্পত্তির নামজারি, সরকারি জমির লিজ গ্রহণ বা নবায়নের জন্য জেলা প্রশাসকের পূর্ব অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা হয়। শিল্প জেলা হওয়ায় প্রতি মাসে জমা পড়তে থাকে শত শত আবেদন। এতেই কপাল খুলে যায় কানুনগো জাহাঙ্গীর আলম নান্নুর। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (এডিসি) গোপনীয় সহকারী রাকিবুল হাসানের সাথে সিন্ডিকেট করে নানা ছুতোয় ফাইল আটকে নামেন ‘ঘুষবাণিজ্যে’।
গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী শিল্প এলাকার একটি শিল্প-কারখানার প্রতিনিধি নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, সাড়ে ৪ বিঘা জমির পূর্ব অনুমোদনের জন্য দেড় বছর ধরে ঘুরছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান ৫০-৬০ বিঘা জমির পূর্ব অনুমোদনের আবেদন দিয়ে ঘুরছেন। সময় মতো ব্যাংকে বন্ধক দিতে না পারায় ঋণ নবায়ন করতে পারছেন না। থমকে আছে ব্যবসা-বাণিজ্য। তাই শিল্প মালিকদের কাছে আতঙ্কের নাম কানুনগো নান্নু। গত ৪ বছরে যখন যিনি এডিসির দায়িত্বে এসেছেন তিনিই তার কাছের লোক বনে গেছেন। তবে এখন পরিস্থিতি ভিন্ন।
নগরীর যোগীতলা এলাকার জনৈক ব্যক্তি বলেন, চান্দনা মৌজায় তাদের ৩৪ শতাংশ জমি রয়েছে। ওই দাগে ৬৮ শতাংশ জমির মধ্যে বাকি ৩৪ শতাংশ সরকারি অর্পিত জমি। তার বোন ও বোন জামাই জটিল রোগে আক্রান্ত। এ কারণে ওই ৩৪ শতাংশ জমি বোনকে দিয়েছেন বিক্রি করে চিকিৎসার জন্য। কিন্তু একই দাগে সরকারি জমি থাকায় সীমানা নির্ধারণ না থাকার কারণে নামজারি ও খাজনা দিতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে আড়াই বছর আগে সীমানা নির্ধারণের জন্য আবেদন করেন। জমির কাগজপত্র ঠিক থাকায় দেড় বছর আগে ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে তার ফাইলটি এডিসি অফিসে আসে। ৬ মাস আগে ফাইল গায়েব হয়ে যায়। বহু খোঁজাখুঁজির এক মাস পর ফাইল পাওয়া গেলেও এখনো পড়ে আছে কানুনগোর টেবিলে। আবেদনের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে গিয়ে আড়াই বছরে ৮০ দিনের বেশি ইউনিয়ন ভূমি অফিস, উপজেলা ভূমি অফিস ও কানুনগোর অফিসে যাতায়াত, টিফিন ইত্যাদির পিছনে ১০ হাজারের বেশি টাকা ব্যয় হয়ে গেছে তার।
আরো করুণ জেলার শ্রীপুর উপজেলার সেরাআলী গ্রামের বৃদ্ধ মোতাহার হোসেনের (৬০) ভোগান্তির গল্প। আক্ষেপ করে বলেন, জমির সাথে সরকারি জমি থাকায় সীমানা নির্ধারণের জন্য তিনি আবেদন করেন গত বছরের নভেম্বর মাসে। ইউনিয়ন ভূমি থেকে ওই আবেদনপত্রের প্রতিবেদন গাজীপুর আসতেই চলে যায় ৮ মাস। গত ৭ জুলাই তার আবেদনপত্রটি আসার পর ৩ মাসের বেশি সময় ধরে কানুনগোর টেবিলে পড়ে আছে।
জানা গেছে, সরকারি চাকরিতে যোগদানের আগে নান্নুর পরিবার ছিল অসচ্ছল। সার্ভেয়ার পদে চাকরি পাওয়ার পর বদলে যেতে থাকে তার ভাগ্যের চাকা। ২০২০ সালে পদোন্নতি পান কানুনগো পদে। ২০২২ সালে মুন্সীগঞ্জ থেকে যোগ দেন গাজীপুরে এসএ শাখায়। সরকারি কর্মচারী হিসেবে দাখিল করা সম্পদের বিবরণ অনুযায়ী জাহাঙ্গীর আলম নান্নুর গ্রামের বাড়ি বাউফলে রয়েছে ছোট জালিমা মৌজায় নিজ নামে ১৫ শতাংশ ও ৪৯ শতাংশের দুটি প্লট, বাউফল মৌজায় নিজ ও স্ত্রীর নামে ৬.৬০ কাঠার প্লট, দক্ষিণগাঁও মৌজায় আরো একটি প্লট, স্বামী-স্ত্রীর নামে ৩৮ লাখ টাকা, বাউফল, গাজীপুর ও ঢাকায় ইট-বালু-রড এবং মজুদ ব্যবসা। কাগজে কলমে ব্যবসার মূলধন ২২ লাখ টাকা দেখানো হলেও বাস্তবে কয়েক কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন তার ঘনিষ্ঠরা। এর বাইরে ঢাকার উত্তরায় ফ্ল্যাট, বাউফল শহরে বাড়ি ও এলাকায় তার ১৫ বিঘার বেশি জমি রয়েছে বলে জানা গেছে। জানতে চাইলে কানুনগো জাহাঙ্গীর আলম নান্নু সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, কর্মচারীদের মধ্যে সামান্য ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। ওই ভুল বোঝাবুঝি মিটে গেছে।
এসব বিষয়ে গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ কায়সার খসরু বলেন, তিনি তিন সপ্তাহ আগে যোগদান করেছেন। অভিযোগগুলো আগের। তার পরও খোঁজ নিবেন। তবে ওই কানুনগো স্বেচ্ছায় বদলির আবেদন করায় সুপারিশসহ গত সপ্তাহে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। দৈনিক সময়ের কণ্ঠ পত্রিকায় চোখ রাখুন